খুলনা, বাংলাদেশ | ৩০ মাঘ, ১৪৩১ | ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

Breaking News

  প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন, কার্যক্রম শুরু ১৫ ফেব্রুয়ারি
  ভোলার তজুমদ্দিনে গরু চুরির অভিযোগে গণপিটুনিতে দুই যুবকের মৃত্যু
  ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্ট সামিট ২০২৫ সম্মেলনে অংশ নিতে দুবাই পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা

শবে বরাত : কুরআন-হাদীসের আলোকে ফজিলত ও বিদআত

হাফেজ মুফতি রাকিবুল ইসলাম বায়েজিদ

আগামীকাল শুক্রবার দিনগত রাতে পবিত্র নিসফে মিন শাবান  বা মধ্য শাবানের রাত। আমাদের উপমহাদেশে রাতটি শবে বরাত হিসেবে পরিচিত।

ইসলামে বিশেষ কিছু রাতকে ফজিলতপূর্ণ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যেগুলোতে ইবাদতের প্রতি বিশেষ তাগিদ দেওয়া হয়েছে। শবে বরাত এমন একটি রাত, যা উপমহাদেশসহ বিভিন্ন মুসলিম সমাজে বিশেষভাবে পালিত হয়। তবে এ রাত নিয়ে অনেক ভ্রান্ত ধারণা ও কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে, যা সুন্নাহর শিক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই কুরআন-হাদীসের আলোকে শবে বরাতের প্রকৃত মর্যাদা ও বিদআতের বেড়াজাল সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেওয়া প্রয়োজন।

কুরআন ও হাদীসের আলোকে শবে বরাতের ফজিলত

১. শবে বরাত সম্পর্কে কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি

কিছু মুফাসসিরে কুরআন মনে করেন, সূরা আদ-দুখানের আয়াত—

“ফীহা ইউফরাকু কুল্লু আমরিন হাকীম”
(এই রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়।) (সূরা আদ-দুখান: ৪)

—এই আয়াতে ‘লাইলাতুল বরাত’ বা শবে বরাতের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ তাফসিরবিদের মতে, এখানে লাইলাতুল কদরের কথা বোঝানো হয়েছে, কারণ তাকদিরের লিখন সংক্রান্ত বিষয় কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী লাইলাতুল কদরেই নির্ধারিত হয়।

শবে বরাতের রাতে ভাগ্য নির্ধারণ হয়—এমন কথা কুরআন ও সহীহ হাদীসের ভিত্তিতে সঠিক নয়। অনেকেই ভুলবশত মনে করেন যে, এই রাতে মানুষের ভবিষ্যৎ, রিজিক, আয়ু ও ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু কুরআন ও তাফসিরের আলোকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, ভাগ্য নির্ধারণ হয় লাইলাতুল কদরের রাতে, শবে বরাতে নয়।

২. শবে বরাতের মর্যাদা সম্পর্কে রাসুলের স. হাদিস হাদীস

কিছু সহীহ হাদীসে শবে বরাতের গুরুত্ব সম্পর্কে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:

“যখন শাবান মাসের মধ্যরাত আসে, তখন আল্লাহ আসমান-দুনিয়ার দিকে তাকান এবং মুশরিক ও বিদ্বেষী ছাড়া সকলের গুনাহ মাফ করে দেন।” (ইবনে মাজাহ: ১৩৯০)

এই হাদীসের আলোকে বোঝা যায়, শবে বরাত গুনাহ থেকে ক্ষমা লাভের একটি সুযোগ। তবে এ রাতের জন্য কোনো নির্দিষ্ট ইবাদতের নির্দেশনা নেই।

শবে বরাতের সুন্নতি আমল

১. তওবা ও ইস্তেগফার:

এ রাতে ব্যক্তিগতভাবে গুনাহ থেকে ক্ষমা চাওয়া এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করা সুন্নত।

এ রাতে তওবা ও ইস্তেগফার করা একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। এ রাতে আল্লাহ তায়ালা বিশেষভাবে তার বান্দাদের প্রতি রহমত অবতীর্ণ করেন এবং যাদের গুনাহ থাকে, তাদেরকে ক্ষমা করেন। এই রাতের বিশেষ ফজিলত ও তওবা-ইস্তেগফারের গুরুত্ব নিয়ে কিছু হাদীস রয়েছে:

“শবে বরাতের রাতে আল্লাহ তায়ালা আসমানী দরবারে উপস্থিত হন এবং বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার কাছে দোয়া করবে, আমি তাকে দোয়া দেব। যে ব্যক্তি ক্ষমা চাইবে, আমি তাকে ক্ষমা করব।’ ” (ইবনে মাজা, হাদীস 1389)

এ রাতের শেষ তৃতীয়াংশে আল্লাহ তায়ালা আসমান থেকে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন এবং বলেন, ‘কেউ কি আছে যে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব?’ ” (তিরমিজি, হাদীস 3579)

২. নফল নামাজ:

নবী (সা.) বলেছেন, “শবে বরাতের রাতে আল্লাহ তায়ালা তার সৃষ্টির প্রতি বিশেষ রহমত প্রেরণ করেন এবং দোয়া গ্রহণ করেন” (তিরমিজি, হাদীস 739)।

বিশেষ কোনো নামাজের নির্দিষ্টতা ছাড়াই সাধারণ নফল নামাজ পড়া যেতে পারে। রাসূল ﷺ সালাতুল তাসবীহ আদায় করার জন্য বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। আমাদের সারা বছর এটি পড়ার সময় ও সুযোগ হয়ে ওঠে না, এজন্য এ রাতটি সালাতুত তাসবিহের জন্য একটি উপযুক্ত সময়।

সালাতুত তাসবীহ নামাজ সম্পর্কে একটি বিখ্যাত হাদিস:

আব্বাস রাজিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম বলেন –

“হে চাচা! আমি কি তোমাকে দান করব না? আমি কি তোমাকে উপহার দেব না? আমি কি তোমাকে কিছু শিখাব না? তুমি যদি এটি পালন করো, তাহলে আল্লাহ তোমার সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন—আগের ও পরের, ছোট ও বড়, গোপন ও প্রকাশ্য।”
(আবু দাউদ: ১২৯৭, তিরমিজি: ৪৮১, ইবনে মাজাহ: ১৩৮০)

রাসূল ﷺ তার চাচা আব্বাস (রাযি.)-কে সালাতুত তাসবীহ নামাজের শিক্ষা দিয়েছেন এবং বলেছেন, এই নামাজ দ্বারা সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যায়।

৩. কুরআন তিলাওয়াত ও দোয়া:

এই রাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য দোয়া ও কুরআন তিলাওয়াত করা উত্তম।রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এরশাদ করেছেন “সর্বোত্তম ইবাদত হল কুরআন তিলাওয়াত করা।”- ইবনে মাজা (হাদীস 3790)

“যে ব্যক্তি রাতে কুরআন তিলাওয়াত করবে, তার জন্য আল্লাহ প্রতিটি বর্ণের জন্য এক এক ধরণের নেকী লিখে দেন।” (মুসলিম, হাদীস 804)

৪.তাহাজ্জুদ নামায:

শবে বরাতের রাতে তাহাজ্জুদ নামায পড়া বিশেষ ফজিলতপূর্ণ।

আল্লাহ বলেন, “রাত্রে তাহাজ্জুদ পড়, এটি তোমার জন্য অতিরিক্ত মর্যাদা দান করবে” (আল-ইসরা, 17:79)।

৪. শরিয়তসম্মত ইবাদত:

বিদআত ও কুসংস্কার পরিহার করে রাসূল ﷺ প্রদত্ত আমলগুলো পালন করা উচিত।

শবে বরাতের ফজিলতসমূহ

1. আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা: আল্লাহ এই রাতে তার বান্দাদের প্রতি বিশেষ রহমত প্রেরণ করেন এবং যারা ক্ষমা চায়, তাদের গুনাহ মাফ করেন।(ইবনে মাজা, হাদীস 1389)

2. দোয়া কবুল: এ রাতে আল্লাহ তায়ালা যাদের দোয়া করেন, তাদের দোয়া কবুল করেন।(তিরমিজি, হাদীস 3579)

3. গুনাহ মাফ: শবে বরাতের রাতে যারা তওবা করেন, আল্লাহ তাদের গুনাহ মাফ করে দেন।

(আল-বুখারি, হাদীস 1835)

4. জান্নাতের প্রাপ্তি: এই রাতে আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের মাফ করেন, ফলে জান্নাতের পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। (তিরমিজি, হাদীস 3581)

 

বিদআতের বেড়াজাল: শবে বরাত নিয়ে প্রচলিত কুসংস্কার

১. শবে বরাতের নির্দিষ্ট নামাজ

কিছু মানুষ মনে করেন, শবে বরাতের রাতে ১০০ রাকাত নামাজ পড়া বিশেষ ফজিলতপূর্ণ। কিন্তু সহীহ হাদীসে এমন কোনো আমলের প্রমাণ নেই।

কিছু মানুষ এই রাতে কিছু বিশেষ নামাজের রাকআত পড়ার জন্য উৎসুক থাকে, যেমন ১২ রাকআত নামাজ পড়া ইত্যাদি, যা সরাসরি হাদীসে প্রমাণিত নয়।

কিছু মানুষ মনে করে, শবে বরাতের রাতে আল্লাহর কাছে বিশেষভাবে প্রার্থনা করতে হলে মোমবাতি বা আলো জ্বালানো উচিত, যা ইসলামে অনুমোদিত নয়।

২.শবে বরাতের নির্দিষ্ট রোজা

অনেকে শবে বরাতের পরের দিন রোজাকে ফরজ বা ওয়াজিব মনে করেন, যা সঠিক নয়। তবে ১৫ তারিখ আইয়ামে বীজের (আরবী মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখ) একটি দিন হিসেবে ১৫ তারিখের রোযাকে সুন্নত মনে করা যাবে। কিন্তু পৃথকভাবে শাবান মাসের ১৫ তারিখ বিশেষ একটি দিন, সে হিসেবে পৃথকভাবে এ দিনে রোযা রাখা সুন্নত―এমন ধারণা রাখা সঠিক নয়।

একটি লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, শাবানের এই ১৫ তারিখ তো ‘আইয়ামে বীয’ এর অন্তর্ভুক্ত। আর নবীজী প্রতি মাসের আইয়ামে বীয এ রোযা রাখতেন। সুতরাং যদি কোনো ব্যক্তি এই দুই বিষয়কে সামনে রেখে শাবানের ১৫ তারিখের দিনে রোযা রাখে যা ‘আইয়ামে বীয’ এর অন্তর্ভুক্ত, পাশাপাশি শাবানেরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন, তবে ইনশাআল্লাহ নিশ্চয়ই সে সওয়াব পাবে। তবে শুধু ১৫ শাবানের কারণে এ রোযাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে সুন্নত বলে দেওয়া অনেক আলেমের মতেই সঠিক নয়।

৩.নির্দিষ্ট দান বা সদকা দেওয়া:

কিছু মানুষ মনে করে যে, শবে বরাতের রাতে বিশেষ পরিমাণ দান বা সদকা দিলে তারা বেশি বরকত পাবে বা তাদের পাপ ক্ষমা হবে। কিন্তু দান করা সারা বছরই একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, এবং এটি নির্দিষ্ট রাতের সাথে সম্পর্কিত নয়।

৪. কবরে রুহের আগমন ও বিশেষ দোয়া

অনেক সমাজে প্রচলিত আছে যে, শবে বরাতে মৃতদের রুহ পৃথিবীতে ফিরে আসে এবং তাদের জন্য বিশেষ খাবার দেওয়া দরকার। অথচ ইসলামে এর কোনো ভিত্তি নেই।

৫. রুটি-হালুয়া ও অন্যান্য কুসংস্কার

উপমহাদেশের অনেক জায়গায় শবে বরাত উপলক্ষে বিশেষভাবে রুটি-হালুয়া তৈরি করা হয় এবং এটিকে সওয়াবের কাজ মনে করা হয়। অথচ ইসলামে এই ধরণের খাদ্যসংস্কৃতি পালনের নির্দেশনা নেই। এটি একটি সামাজিক রীতি, যা ধীরে ধীরে ধর্মীয় আচার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

৬.সম্মিলিত দোয়া ও মিলাদ মাহফিল

শবে বরাতের নফল আমলসমূহ একাকীভাবে করা উচিত, দলগতভাবে নয়। ফরয নামায মসজিদে আদায় করার পর, নফল আমল নিজ ঘরে একাকী করা উচিত। মসজিদে সমবেত হয়ে আমল করার কোনো প্রমাণ হাদীস বা সাহাবায়ে কেরামের যুগেও ছিল না (দ্র. ইক্তিযাউস সিরাতিল মুসতাকীম ২/৬৩১-৬৪১; মারাকিল ফালাহ, পৃ. ২১৯)।

কিছু জায়গায় মাগরিব বা এশার পর ওয়াজ, মিলাদ বা খতমে-শবীনা আয়োজন করা হয়, যা ভুল রেওয়াজ। মাইকে বক্তৃতা বা ওয়াজের আয়োজন ইবাদতে মনোনিবেশে বাধা সৃষ্টি করে এবং অসুস্থদের বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটায়।

উপসংহার

শবে বরাতের প্রকৃত ফজিলত সম্পর্কে জানতে হলে কুরআন ও সহীহ হাদীসের দিকে তাকাতে হবে। বিদআত ও কুসংস্কারের বেড়াজালে আটকে গিয়ে মূল শিক্ষা ও উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরে যাওয়া উচিত নয়। এই রাত ইবাদত, আত্মশুদ্ধি ও গুনাহ থেকে মুক্তির একটি সুযোগ, যা বিদআত ও ভিত্তিহীন রীতিনীতির মাধ্যমে নষ্ট করা উচিত নয়। তাই আমাদের উচিত সুন্নাহর পথে থেকে এ রাতকে যথাযথভাবে কাটানো এবং সমাজে প্রচলিত বিদআত ও কুসংস্কার থেকে দূরে থাকা।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন।

 

লেখক : হেফজ সমাপনীতে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ বোর্ড পরীক্ষায় মুমতাজ (A+)

দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স সমাপনী) প্রথমবার: আল-হাইআতুল উলিয়া লিল কওমিয়াতিল জামিয়া বাংলাদেশ পরীক্ষায় মুমতাজ (A+)

দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স সমাপনী) – দ্বিতীয়বার: দারুল উলূম দেওবন্দ, ভারত

ইফতা সমাপনী (ইসলামী আইন গবেষণা বিভাগ): মুমতাজ (A+)

তাফসিরুল কোরআন সমাপনী, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, ঢাকা ফলাফল: মুমতাজ (A+)




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!